শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:২০ অপরাহ্ন
ভয়েস অব বরিশাল ডেস্ক॥ নারায়ণগঞ্জে তল্লা এলাকায় এখনও ঘরে ঘরে বইছে শোকের মাতম। কে কাকে সান্তনা দেবে, ভাষাও যেন এখন আর নেই কারও। তাদেরই একজন নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের কর্মচারী নুরুদ্দিন। বিস্ফোরণে তার দুই ছেলেই মারা গেছে। জীবনের সব আশা আর স্বপ্ন নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে কোনোদিনও এমন চিন্তা করেননি নুরুদ্দিন। এখনও তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না, সব বাস্তব নাকি কোনো ঘোর!
তল্লা এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, নিহতদের পরিবারের লোকজনের আহাজারিতে চারপাশ ভারী। বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন নিহতের পরিবারের সদস্যদের অনেকেই। তাদের সঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্থানীয়রাও।
কারও সান্ত্বনাই নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের কর্মচারী নুরুদ্দিনের মনকে শান্ত করতে পারছে না। ক্রমাগত কেঁদেই চলেছেন তিনি। কথা বলার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছেন। নুরুদ্দিনের কান্না আর শোকে কাতর প্রেসক্লাবের সব কর্মকর্তা ও সদস্যসহ জেলার সাংবাদিকরাও। সর্বস্তরের গণমাধ্যম কর্মীদের হৃদয়ও ভারী হয়ে আছে নুরুদ্দিনের দুই পুত্র হারানোর ব্যথায়।
নুরুদ্দিন প্রায় ত্রিশ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবে চাকরি করে আসছেন। বড় ছেলে সাব্বির নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজে অনার্স এবং ছোট ছেলে জুবায়ের একই কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলো। দুই ছেলে ছাড়াও এক মেয়ে রয়েছে তার। ছেলে-মেয়েদের মানুষ করতে দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে প্রেসক্লাবে অর্ধবেলা চাকরির পাশাপাশি কখনো ফুটপাথে দোকানদারি, কখনো রিকশা, কখনো কুলির কাজও করেছেন নুরুদ্দিন। স্বপ্ন ছিলো ছেলেরা লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হবে। সংসারের হাল ধরলে পরিশ্রম থেকে কিছুটা রেহাই পাবেন।
কিন্তু একসঙ্গে প্রায় উপযুক্ত বয়সের দু’টি পুত্র হারানোর পর আর কিছুই ভাবতে পারছেন না তিনি। শোকাতুর বাবা নুরুদ্দিন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ছেলেরা আমারে চিরতরে রেহাই দিয়া চইলা গেলো। আমার আর কোনো আশা ভরসা নাই। এখন আমি কি নিয়া বাঁচমু? আমার তো আর কোনো কিছুই রইলো না।
নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহাবুবুর রহমান মাসুম বলেন, “এর চেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা আর হতে পারে না। এক সাথে দুই সন্তানের লাশের ভার বহন করা একজন বাবার পক্ষে সম্ভব না। নুরুদ্দিন অনেক আশা নিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে এই দুই ছেলেকে এই পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়েছে। এতো কষ্ট কেন করো জানতে চাইলে নুরুদ্দিন প্রায় সময়ই আমাদের বলতো, ‘স্যার আর কয়েক বছর পরে ছেলে দুইটা লেখাপড়া শেষ কইরা ফেললে আমার আর এত কষ্ট করতে হইবো না’।
নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি আরও বলেন, ‘এ ঘটনায় প্রেসক্লাব নয়, নারায়ণগঞ্জের পুরো সাংবাদিক সমাজ মর্মাহত। আমরা নুরুদ্দিনের পাশে আছি। তার ভবিষ্যৎ জীবন কিভাবে চলবে সেই বিষয়টি আমরা দেখব, যাতে কারো কাছে গিয়ে হাত পাততে না হয়।
সালাম মিয়া নামে স্থানীয় এক এলাকাবাসী বলেন, ‘এশার নামাজের শেষের দিকেই হঠাৎ মসজিদে বিকট শব্দ হয়। মুহূর্তের মধ্যেই আগুন ধরে যায় মসজিদের ভেতরে। তখন সবাই প্রাণ বাঁচাতে দৌঁড়ে মসজিদ থেকে বের হয়। কেউ কেউ সড়কে পড়েই গড়াগড়ি খাচ্ছিলেন। এমন দৃশ্য আমি আমার জীবনে দেখি নাই।
তিনি আরও বলেন, ‘পোড়া মানুষের ছটফটানি দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে ছিল সবাই। যে যেভাবে পারে পুড়ে যাওয়া মানুষদের হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করছি। অনেকে আবার ভয়ে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিল না। মসজিদের ভেতরের ফ্লোর এবং বাইরে শুধু রক্ত আর রক্ত পড়ে ছিল।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার রাতে এশার নামাজ চলাকালে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে নারায়ণগঞ্জ শহরের পশ্চিম তল্লা এলাকার বায়তুস সালাত জামে মসজিদে। এসময় মসজিদের ছয়টি এয়ারকন্ডিশন, অ্যাডজাস্ট ফ্যানসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র ও জায়নামাজ পুড়ে যায়। অধিকাংশ সিলিং ফ্যান নষ্ট এবং দরজা জানালার সব কাঁচ ভেঙে টুকরো হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। এ বিস্ফোরণে মুসল্লিদের মধ্যে গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় ৩৭ জনকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে। এ দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
Leave a Reply